লেখক সামছুন্নাহার শেলীর ”নিশির কান্না ”

প্রকাশনায়:-বি এম বাবলুর রহমান।
  • Update Time : Monday, March 15, 2021
  • 940 Time View

কখনো কখনো জীবন টা অসহ্য মনে হয়। বেঁচে থাকার ইচ্ছা ও মরে যায়। বিরক্ত এসে যায় জীবনের প্রতি।এর মধ্যে ফোন টা বাজতে থাকে বার বার। চরম বিরক্তিতে ফোন টা রিসিভ করে বলি,’কি সমস্যা,কেন বার বার কল দিচ্ছো,আমি তো বলেছি,কাজ শেষ করেই বাসায় ফিরবো।হাটতে হাটতে কথা বলছি ফোনে। বলতে বলতে সামনে তাকিয়ে দেখি,সামনে আমার অতীত দাড়িয়ে আছে।এক সময়ের উজ্জ্বল অতীত আজ ধুলা জমতে জমতে ঝাপসা হয়ে গেছে। আমি ভুল দেখছি কিনা বুঝতে পারছি না। আমার মুখ দিয়ে আর কথা বের হচ্ছে না। চোখ স্থির হয়ে গেছে।পা থমকে দাঁড়িয়েছে। আমি কি সত্যি দেখছি,নাকি কল্পনা। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।ফোনের আপার প্রান্ত থেকে কথা বলছে পুষ্প,পুষ্প শুনতে পাচ্ছ পুষ্প,কি হয়েছে তোমার। তখন আমি আস্তে আস্তে বলি,তুমি বলো আমি শুনছি। আর চুপ চাপ শান্ত ভাবে কথা শেষ করি।ফোনের আপার প্রান্তে আমার বর্তমান আর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতি জড়ানো অতীত। কিছু টা দ্বিদা দন্ধের মধ্যে পড়েছি।আমি দাড়িয়ে আছি নাকি সেটা ও বুঝতে পারছি না।

আজ এতো দিন পর ”শিমুল ”।এই সেই শিমুল যার সাথে বহু স্মৃতি আছে,যা আজো মনে ভেসে ওঠে। আমি দাঁড়িয়ে আছি,শিমুল ও দাড়িয়ে আছে,দুজনেই চুপচাপ। তার পর আমিই প্রশ্ন করি,কেমন আছো শিমুল?শিমুল বলল, আগে ভালো ছিলাম,কিন্তু এখন আমি জানি না কেমন আছি।বাঁকা চোখে একটু হাসি দিয়ে বলি,ভালো ছিলাম মনে কি?আমাকে দেখে খারাপ লাগছে নাকি?অনেক টা শুকনো হাসি দিয়ে বলল,ঠিক তা নয়।তার পর বলো,তুমি কেমন আছো ‘তোবা’? হুম সব মিলিয়ে আলহামদুল্লিল্লাহ ভালো আছি।

শিমুল অনেক দিন পর দেখা হল তোমার আমার। জীবনের অনেক টা সময় পার হয়ে গেছে ।শিমুল তুমি অনেক চুপ চাপ হয়ে আছো,কিন্তু কেন,আজো ও আমার উপর রেগে আছো তুমি? শিমুল বলল,আরে না না,কি যে বলো তুমি। এতো টুকু বলেই দীর্ঘশ্বাস নিল।শিমুল কে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক কষ্টের মধ্যে আছে। না জেনে কিছু বলা ঠিক হবে না। এর পর দুজনে বিভিন্ন কথা বলি আর হাটতে শুরু করি।আমি প্রশ্ন করছি শিমুল ছোট ছোট করে উত্তর দিচ্ছে মাত্র ।মাথা নিচু করে চলছে।এদিকে ওদিকে তাকিয়ে আমার প্রশ্নেরউত্তর দিচ্ছে।এবার আমি থমকে দাঁড়িয়ে যায় ।তাকিয়ে থাকি শিমুলের মুখের দিকে। শিমুল মুখ তুলে বলল,কি হল তোমার,তুমি হটাৎ থেমে গেলে,কিছু বলবে?
শিমুল,তুমি কি আজো আমার বাবা কেই দোষী মনে করো?আসলে বাবা তোমাকে সেই দিন বলেছিলো,চাকরি না পেলে আমাকে ভুলে যেতে,বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে,আরো কত কি? কথা গুলো আমার মনে আছে। তুমি মাথা নিচু করে সব কথা শুনে চলে এসেছিলে।তার পর আর কখনো আমাদের দেখা হয়নি।শিমুল বলল,তোবা এইসব কথা ভুলে গেছি অনেক আগে,তুমি ভুল ভাবছো।তোবা জোর গলায় বলল,তা হলে কি সমস্যা?কেন তুমি এতোদিন পর আমার সামনে এলে?আর আসলেই যখন তখন চুপচাপ কেন?
ঘাড় নেড়ে শিমুল বলল,তোবা তুমি একই রকম রয়ে গেছো,কোন কিছুই পরিবর্তন হয়নি তোমার,শুধু সময় পার হয়েছে অনেকটা।

তোবা বলল,শিমুল তোমার কথা বলো,তোমার জীবনের কথা বলো,তোমার জীবনে কতটা পরিবর্তন এসেছে আমি জানতে চাই। তোবা খেয়াল করছে,শিমুলের চোখ লাল বর্ণ ধারণ করছে।ছেলে মানুষ তো চোখে পানি নেই তবে হতাশার আগুন জ্বলছে দুচোখে।আজকের এই শিমুল আর সেই শিমুলের মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমি শিমুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি,দিশেহারা হয়ে গেছি কি করব ভেবে পাচ্ছি না। আস্তে আস্তে আমি বলি,শিমুল এই শিমুল আমাকে বলো কি হয়েছে, আমি শিমুলের কাঁধে হাত রাখি ভাবনা চিন্তা হীন ভাবে। শিমুল আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল,তোবা আমি জীবনে সব কিছুই হারিয়ে ফেলেছি। আমার জীবনে সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার আর কোন আশা নেই। আমি প্রতি নিয়ত একটু একটু করে মরে বেঁচে আছি। আমি এখনো কেন বেঁচে আছি জানি না। তোবা বলল,শিমুল খুলে বলো,কেন তুমি জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাও।শিমুলের চোখে পানি ছলছল করছে।শিমুল বলল,আমার বিবাহিত জীবন প্রায় এগারো বছর হল। এই পর্যন্ত তিন বার গর্ভ ধারণ করছে ”নিশি”।কিন্তু বাচ্চা শেষ রক্ষা করতে পারেনি,আর ডাক্তার বলেছেন এবার মা হতে চাইলে লাইফ রিক্স আছে,এবং প্রায় অসম্ভব। মানে ”নিশি”আর কখনো মা হতে পারবে না।

আমি নিশির চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না। নিশি একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকে। আমি নিশিকে বলেছি,আমার বাচ্চা চাই না,আমি তোমাকে চাই সারা জীবন ধরে। তোবা বলল,হ্যাঁ ঠিক বলেছো তো সমস্যা কোথায়?এবার শিমুলের চোখে পানি গড়িয়ে পড়ল শিমুলের জুতার উপর। শিমুল আর আমি একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।আশে পাশে অনেক লোকজনে পরিপূর্ণ। আমি শিমুলের হাতটি শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ওকে স্বন্তনা দেওয়ার ভাষা বা ক্ষমতা আমার নেই আর ওর চোখের পানি আমি সহতে পারছি না। আবার বলি,শিমুল বলো তার পর।এবার শিমুল বলল,
তোবা,আমি অফিসের কাজে দিনের বেশি ভাগ সময় বাইরে থাকি,নিশি বাচ্ছার জন্য পাগলের মত আচরণ করে। আমি দেখতে পাচ্ছি নিশি জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে। আর মা,বাবা এখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নিশির উপর। তারা চাই আমি আবার বিয়ে করে বউ,বাচ্চা নিয়ে সুখে থাকি।এটা নিয়ে সব সময় অশান্তি লেগে আছে। আর এই কারণে নিশি বাড়ি থেকে চলে গেছে আজ দুই দিন ।আমি এই দুই দিন কোথাও খুজতে বাদ রাখেনি কিন্তু সন্ধান মেলেনি।তোবা বলো তুমি,আমি কি করব,আমি আর কোথায় খুঁজলে নিশিকে পাব,বলো তোবা বলো,বলে শিমুল অঝোরে কাঁদতে লাগল। কিছু টা ভেবে তোবা বলল,শিমুল এতিম খানা গুলি তে দেখতে পারি।অথবা যে খানে বাচ্ছারা থাকে সেই সব জায়গায় খোঁজ নিতে পারি।আমার ধারণা নিশিকে এইসব জায়গায় পাওয়া যেতে পারে। বাকিটা আল্লাহ্ ভরসা।

শিমুল আমি বাড়িতে একটু কথা বলি, সবাই চিন্তা করবে।বাসায় ফোন করে দিলাম আমার আসতে দেরি হবে,আর এসে সব কথা বলব,এতটুকু বলি,আমার পাঁচ বছরের মেয়ে টা ফোনের পাশে আম্মু আম্মু বলছে,আমি শুনতে পাচ্ছি।তাজ আমার স্বামী।তাজ কে বলি আমরা ফিরতে দেরি হবে,তোমাকে ফোন দিয়ে সব বলব।

এর পর দুজনে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ খবর নিতে থাকি।একে একে খুঁজতে খুঁজতে প্রায় শেষের দিকে আর অনেক আগেই সন্ধা নেমেছে।রাস্তার দুই পাশে আলো জ্বলছে। সন্ধার রাস্তায় বেশি লোকজন থাকে। সন্ধ্যার পর রাত বেড়ে চলেছে আমি আর শিমুল রিকসা করে চলছি।একেবারে হতাশ হয়ে আছি দুজনে। আমি ও আর থাকতে পারছি না। বাসা থেকে বার বার কল দিচ্ছে।এবার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম দুজনে। শিমুল মাথার চুল গুলো টানছে আর চোখের পানি ঝরছে। আমি এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেকছি হটাৎ শিমুল রিকশা থেকে লাফিয়ে পড়ল,আমি হতবাক,,,,,,,,

সাথে সাথে আমি ও নেমে যায়। শিমুল অস্থির হয়ে গেছে আর পাগলের মত করছে।আমি দৌড়ে শিমুলের কাছে যায়।শিমুল শিমুল বলে জোরে হাঁটতে থাকি। শিমুল কি হয়েছে?শিমুল কাঁদতে কাঁদতে বলে এই আমার ”নিশি” আমার জীবন,আমার আশা,আমার সব কিছুই। শিমুল নিশিকে জড়িয়ে ধরে বলছে,নিশি কোথায় ছিলে তুমি?নিশি কথা বলো,আমার জান। তোবা,আমি নিশি কে পেয়েছি। এই আমার নিশি,আমার পৃথিবী। নিশি কোন কথা বলছে না।আমি বলি,শিমুল নিশি মনে হচ্ছে স্বাভাবিক নেই। এবার শিমুল খেয়াল করল নিশির শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে,আর অনেক অসুস্থ। আমি আর শিমুল নিশি কে নিয়ে ক্লিনিকের উদ্দেশে রওনা দিলাম। নিশির অবস্থা মোটেই ভালো নয়। আমার ফোন টা বার বার কল হচ্ছে। নিশিকে ক্লিনিকে ভর্তি করছি।ডাক্তার সাহেব দেখছেন।

আমাকে বার বার কল দিচ্ছে ।আমি বাড়িতে ফোন করে ”তাজ” (আমার স্বামী) কে সব সমস্যার কথা খুলে বলি।তাজ সব কিছু শুনে বলল,তুমি ওখানে থাকো,আমি আসছি।আমার মেয়ে টা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর জন্য খুব খারাপ লাগছে। আমি আর শিমুল পাশাপাশি দাড়িয়ে আছি।নিশির কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার করছে।ঘন্টা খানেক পর রিপোর্ট পাওয়া যাবে। এর মধ্যে ”তাজ” চলে আসছে ক্লিনিকে। আমি শিমুল আর তাজ অপেক্ষা করছি,নিশি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। একটু পরে শিমুলের বাবা মা ও আসছো ।নিশির হাত ধরে বসে আছে শিমুল,পাশে বাবা মা সবাই আছে। আমি তাজ কে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। সবাই কমবেশি কথা বলছে।

এবার ডাক্তার সাহেব শিমুল কে ডাক দিল।শিমুল কে অনেক অসহায় লাগছে। আবার ডাক্তার যদি খারাপ কিছু বলে তখন কি অবস্থা হবে ভেবে পাচ্ছি না। এতো শতো না ভেবে শিমুলের সাথে তাজ কে ও পাঠিয়ে দিলাম।বাকি সবাই নিশির কাছে অপেক্ষা করছি। নিশি কান্না করছে।আমি নিশি কে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে স্বন্তনা দিতে থাকি। এমন সময়ে শিমুল আর তাজ দৌড়াতে দৌড়াতে রুমের ভিতরে প্রবেশ করে আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আমরা শিমুলের কান্না দেখে সবাই কাঁদতে থাকি। নিশি জোরে জোরে কাঁদছে। আমি কাকে থামাবো,কি বলব,জানি না। আমি তাজের কাছে প্রশ্ন করি,কি হয়েছে,ডাক্তার কি বলেছেন। তাজ বলল,নিশি ”মা” হতে চলেছে। এবার আমি ও কেঁদে ফেললাম।একটা বাচ্ছার জন্য কত গুলো জীবন অনিশ্চিত আর অসহায় হয়ে পড়েছে।

নিশি শ্বশুর শাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। সবাই কাঁদছে তবে আনন্দে।কিছু সময় পার সবাই স্বাভাবিক হলো।ওদের কে বাড়িতে পৌছে দিলাম।আমি আর তাজ সবাই থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।রাস্তার দুইজন অনেক কথা বললাম। প্রায় বাড়ির কাছা কাছি এসে আমি আর তাজ হাটতে হাটতে যাব বলে রিকসা থেকে নেমে হাটতে শুরু করি।কি এক আনন্দ হৃদয়ের গভীরে খেলা করছে বলে বোঝানো যাবে না। কখনো তাজের ডান হাত ধরে আবার কখনো বাম হাত ধরে হাঁটতে থাকি আর হাটতে থাকি,,,,,,,,,,,,
”শেলী”

যদি কোন ভুল ত্রুটি হয় ক্ষমার সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।
” সমাপ্ত”

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category